" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • জন্ম - মৃত্যুর অতীত

    শ্লোক: ১৫
    কেচিদাহুরজং জাতং পুণ্যশ্লোকস্য কীর্তয়ে ।
    যদোঃ প্রিয়স্যান্ববায়ে মলয়স্যেৰ চন্দনম্ ॥ ১৫ ॥
  • অনুবাদ : কেউ কেউ বলেন যে , পুণ্যবান রাজাদের গুণকীর্তনের উদ্দেশ্যে যিনি অজ তিনি জন্মগ্রহণ করেন , এবং অন্যান্যরা বলেন যে , তোমার এক প্রিয়তম ভক্ত যদুরাজের সন্তোষ বিধানের জন্য তুমি জন্মগ্রহণ কর । মলয় পর্বতে চন্দন কাষ্ঠের আবির্ভাবের মতো তুমি তাঁর পরিবারে আবির্ভূত হও । ( ভাঃ ১/৮/৩২ )
  • তাৎপর্যঃ- এই জড় জগতে ভগবানের আবির্ভাব বিভ্রান্তিকর , কারণ যিনি অজ তাঁর এখানে জন্মগ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে । ভগবদ্‌গীতায় ভগবান বলেছেন যে , তিনি নিখিল সৃষ্টিকর্তা ও স্বয়ং অজ হওয়া সত্ত্বেও এই জড় জগতে জন্মগ্রহণ করেন । যিনি অজ তাঁর জন্মকে অস্বীকার করা যায় না , কারণ তিনি স্বয়ং এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন । তবু , কেন তিনি জন্মগ্রহণ করেন , এই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ভগবদ্‌গীতায় ঘোষণা করা হয়েছে । ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা , পুণ্যবানদের রক্ষা ও পাপীদের নিধনের উদ্দেশ্যে তিনি আত্মামায়ার মাধ্যমে অবতরণ করেন । যিনি অজ তার আবির্ভাবের এটিই উদ্দেশ্য । তবু এটি বলা হয় যে , পুণ্যাত্মা মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জয়গানের জন্য ভগবান আবির্ভূত হন । জগতের সকলের কল্যাণের জন্য অবশ্যই ভগবান কৃষ্ণ পাণ্ডবদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছা করেন । পুণ্যবান রাজার শাসনে জগদ্বাসী সকলে সুখী হয় । কিন্তু শাসনকারী রাজা পাপী হলে জনগণ অসুখী হয় । কলিযুগে অধিকাংশ শাসকবর্গ ধর্মহীন হওয়ায় জনগণও সবাই অসুখী । কিন্তু গণতন্ত্রে দেশের শাসকদের ধর্মহীন নাগরিকরাই নির্বাচিত করে এবং তাই তাদের অসন্তোষের কারণ হিসেবে কাউকে তারা দোষ দিতে পারে না । পুণ্যাত্মা এক মহান রাজা হিসেবে নলের খ্যাতি ছিল , কিন্তু কৃষ্ণের সঙ্গে তার কোন সম্বন্ধ ছিল না । তাই এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়গানের লক্ষ্য হচ্ছে মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদুবংশে জন্মগ্রহণের মাধ্যমে যদুরাজকেও মহিমান্বিত করেছেন । তিনি যাদব , যদুবীর , যদুনন্দন ইত্যাদি নামে পরিচিত , যদিও ভগবান সব সময়ই এই রকম সম্বন্ধগত পরিচয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত । ভগবান হচ্ছেন ঠিক মলয় পর্বতে জাত চন্দন কাষ্ঠের মতো । বৃক্ষ যে কোন জায়গায় , সর্বত্রই জন্মাতে পারে , তবু চন্দন বৃক্ষ বিশেষ করে মলয় পর্বত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করায় , চন্দন ও মলয় পর্বতমালার মধ্যে এক পারস্পরিক সম্বন্ধ আছে । অতএব সিদ্ধান্ত করা যায় যে , ভগবান কৃষ্ণ সূর্যের মতো চিরকালই জন্মহীন , তবু তিনি সূর্যের পূর্ব দিগন্তের মতো আবির্ভূত হন । সূর্য যেমন কোন দিনই পূর্ব দিগন্তের সূর্য নয় , ঠিক সেই রকম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কারও সন্তান নন , কিন্তু তিনি সকলের একমাত্র পিতা ।
    ভগবদ্‌গীতায় ( ৪/৬ ) ভগবান বলেন

    অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্
    প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ॥

    “ যদিও আমি জন্মহীন এবং আমার অপ্রাকৃত দেহ অবিনাশী , এবং যদিও আমি সকল জীবের অধীশ্বর , তবু আমি প্রতি যুগে আমার আদি দিব্যরূপে আবির্ভূত হই । "

       শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অজ , আমরাও অজ । কিন্তু পার্থক্য এই যে , ভগবান জড় শরীর ধারণ করেন না , কিন্তু আমরা জড় দেহে আবদ্ধ হই । তাই আমরা আমাদের অজ স্বরূপ রক্ষা করতে পারি না , কিন্তু জন্মগ্রহণ করতে বাধা হই এবং পরবর্তী দেহ সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা ছাড়াই আমরা এক দেহ থেকে অন্য এক দেহে দেহান্তরিত হই । এমন কি এই জীবনেও আমরা একটির পর একটি দেহ গ্রহণ করতে বাধ্য হই । একটি শিশুদেহ ত্যাগ করে একটি বালকদেহ গ্রহণ করে , এবং বালকটি তার বালকদেহ পরিত্যাগ করে যুবকদেহ গ্রহণ করে , এবং সেই যুবক দেহ ত্যাগ করে সে একটি বৃক্ষদেহ প্রাপ্ত হয় । তাই এই সিদ্ধান্তে আসা স্বাভাবিক যে , কেউ যখন তার বার্ধক্যের দেহ ত্যাগ করে , তখন সে অন্য এক দেহ প্রাপ্ত হবে । আবার সে একটি শিশুদেহ লাভ করবে ।

       এটিই স্বাভাবিক সংসার চক্র , যা ঋতুর মতোই পরিবর্তনশীল । বসন্তের পর গ্রীষ্ম আসে , এবং গ্রীষ্মের পর বর্ষা আসে । তারপর শীত এবং শীতের পর আবার বসস্ত আসে । সেই রকম , দিনের পর রাত্রি এবং রাত্রির পর দিন আসে । আর ঋতুচক্রের মতোই আমাদের এই দেহান্তর ঘটে । এই থেকে স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে , বর্তমান দেহ ত্যাগের পর আমরা অন্য দেহ প্রাপ্ত হব (ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে ) ।

       এই সিদ্ধান্ত যেমন যুক্তি সম্মত , তেমনই বৈদিক শাস্ত্রানুমোদিত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আচার্য স্বয়ং কৃষ্ণও এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন । অতএব আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বীকার করব না কেন ? কেউ যদি এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ না করে , কেউ যদি মনে করে মৃত্যুর পর জীবন নেই , তা হলে সে নিঃসন্দেহে মূঢ় ।

       মৃত্যুর পর আবার জীবন শুরু হয় এবং বার বার জন্ম - মৃত্যুময় ভব সংসার আবর্ত থেকে উদ্ধারের উপায় রয়েছে এবং শাশ্বত , অমর জীবন প্রাপ্তির সুযোগ আছে । কিন্তু স্মরণাতীত কাল থেকে দেহান্তরিত হতে অভ্যস্ত হওয়ায় , আমাদের পক্ষে শাশ্বত অনন্ত জীবনের অস্তিত্ব চিন্তা করা কঠিন । আমাদের এই সংসার জীবন এমন ক্লেশময় যে এক শাশ্বত , অনন্ত জীবনের সম্ভাবনা চিন্তা করলে , সেই জীবনও অবশ্যই দুঃখময় বলে মনে হবে । যেমন একজন রুগ্ন ব্যক্তি যে শয্যাশায়ী হয়ে তিক্ত ওষুধ গ্রহণ করছে , সে সেখানে আহার্য গ্রহণ করে , এবং মল - মূত্র ত্যাগ করে সে চলাফেরায় অক্ষম হয়ে , জীবনকে দুর্বিসহ বিবেচনা করে মনে মনে আত্মহত্যা করার চিন্তা করে । সেই রকম সংসার জীবন এমন দুঃখতাপময় যে , ভবরোগী হতাশাচ্ছন্ন হয়ে কখনও কখনও শূন্যবাদ বা নির্বিশেষবাদ গ্রহণপূর্বক নিজ অস্তিত্বের বিনাশ সাধন করে সব কিছুকেই শূন্য করতে প্রয়াসী হয় । বস্তুত শূন্য হওয়া কিন্তু সম্ভব নয় । শূন্য হওয়ার প্রয়োজনও নেই । মায়াবদ্ধ অবস্থায় আমরা বিপন্ন , কিন্তু ভব - বন্ধন মুক্ত হওয়া মাত্র আমরা আমাদের প্রকৃত জীবন বা সনাতন জীবনের সন্ধান পাই ।

       আমরা কৃষ্ণের অংশ বিশেষ । কৃষ্ণ হচ্ছেন অজ এবং জন্ম ও মৃত্যুর অতীত , তাই আমরাও অজ । আমরা অন্য রকম হতে পারি কি করে ? যদি আমার পিতা সুখী হন এবং আমি তার সন্তান হই , তবে আমি সুখী হব না কেন ? স্বাভাবিকভাবেই আমি সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে , পিতা যেমন ভোগ করছেন , ঠিক সেই রকম আমিও পিতার সম্পদ ভোগ করব । সেই রকম ভগবান কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান , তিনি পূর্ণ শ্রীমান পূর্ণ জ্ঞানবান এবং সব কিছুতেই সম্যক পূর্ণ । যদিও আমি পুর্ণ নই , কিন্তু আমি ভগবানের অংশ বিশেষ , তাই আংশিকভাবে ভগবানের সব গুণই আমার মধ্যে রয়েছে ।

       ভগবানের মৃত্যু নেই , তাই আমাদেরও মৃত্যু হবে না । সেটিই হচ্ছে আমাদের স্বরূপ । এই বিষয়টি ভগবদ্গীতায় ( ২/২০ ) ব্যাখ্যা করা হয়েছে – ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ । আত্মার বর্ণনা প্রসঙ্গে কৃষ্ণ বলেছেন যে , আত্মার কখনও জন্ম হয় না ( ন জায়তে ) , আর জন্মহীনের মৃত্যু হবে কিভাবে ? মৃত্যুর কোন প্রশ্নই উঠে না ( ম্রিয়তে বা ) । যে জন্মগ্রহণ করেছে তারই মৃত্যু হবে , আর যার জন্ম নেই তার মৃত্যুও থাকতে পারে না ।

       দুর্ভাগ্যবশত , যাই হোক , আমরা কিন্তু এই তথ্য জানি না । আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে যাচ্ছি , অথচ আমরা জানি না যে , প্রত্যেক জীবই জন্ম - মৃত্যুহীন চিন্ময় আত্মা । এটি আমাদের অজ্ঞতা । আত্মা হচ্ছে শাশ্বত , নিত্য ও আদি ( নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ) । দেহের বিনাশ হলেও আত্মা অবিনাশী ( ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ) । আত্মা অবিনাশী হলেও অন্য দেহ ধারণ করে , এবং এই দেহান্তরকে ভবরোগ বলে ।

       শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম চেতন ( নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্ ) । আমরাও ঠিক শ্রীকৃষ্ণেরই মতো , শুধু পার্থক্য এই যে , শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন বিষ্ণু বা অসীম আর আমরা হচ্ছি অণু বা সীমিত গুণগত বিচারে আমরা কৃষ্ণের মতোই উত্তম । অতএব শ্রীকৃষ্ণের যে সব প্রবণতা আছে , তা আমাদের মধ্যেও রয়েছে । যেমন , কৃষ্ণের মধ্যে অন্য কাউকে ভালবাসার প্রবণতা আছে তাই আমাদের মধ্যেও সেই একই প্রবণতা রয়েছে । শ্রীশ্রীরাধা - কৃষ্ণের শাশ্বত প্রেমেই রয়েছে প্রেমের সূচনা । আমরাও শাশ্বত প্রেমের অন্বেষণ করছি, কিন্তু আমরা জড়া প্রকৃতির প্রভাবে মায়াকবলিত হওয়ায় আমাদের প্রেম বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে । কিন্তু এই বাধাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হলে , আমরাও রাধা-কৃষ্ণের মতো ভগবৎ - প্রীতি বিনিময়ে অংশ গ্রহণ করতে পারি । তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়া । কিন্তু কৃষ্ণ যেহেতু নিত্য শাশ্বত , তাই আমরাও ভগবদ্ধামে কৃষ্ণলোকে গিয়ে শাশ্বত দেহ লাভ করব ।

       কুন্তীদেবী বলেছেন কেচিদাহুরজং জাতম্ — ' পরমতত্ব নিত্য , তিনি অজ হলেও তিনি এখন জন্মগ্রহণ করেছেন । কিন্তু কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করলেও তার জন্ম আমাদের মতো নয় । আমাদের তা জানা উচিত । ' ভগবদ্‌গীতায় ' ( ৪/১ ) ভগবান বলেছেন-

    জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
    ত্যক্তা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ॥

       “ হে অর্জুন , যারা আমার আবির্ভাব ও কর্মকে দিব্য বলে জানে , দেহাবসানে তারা আর ভবসংসারে জন্মগ্রহণ করে না , পক্ষান্তরে তারা আমার নিত্যধাম প্রাপ্ত হয় । "

       শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে , যখন কৃষ্ণ প্রথমে আবির্ভূত হন , তখন তিনি দেবকীর গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেনি । পক্ষান্তরে , তিনি প্রথমে মহিমাময় চতুর্ভূজ বিষ্ণুরূপে আবির্ভূত হন এবং তারপর তিনি দেবকীর কোলে একটি শিশুরূপে পরিণত হন । তাই কৃষ্ণের জন্ম অপ্রাকৃত , কিন্তু আমরা প্রকৃতির নিয়মে জন্ম নিতে বাধ্য হই । কৃষ্ণ প্রকৃতির অধীন নন , প্রকৃতি কৃষ্ণের অধীন ( ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্ ) । প্রকৃতি কৃষ্ণের নির্দেশে কাজ করে এবং আমরা প্রকৃতির আদেশে কাজ করি । কৃষ্ণ হচ্ছেন মায়াধীশ এবং আমরা হচ্ছি মায়াধীন । তাই কুন্তীদেবী বলেছেন , কেচিদাহুঃ– কেউ বলতে পারে যে , যিনি অজ তিনিই জন্মগ্রহণ করেছেন । আপাতদৃষ্টিতে তিনি আমাদের মতো জন্মগ্রহণ করলেও , বস্তুত তিনি তা করেননি । কুন্তীদেবী স্পষ্টতই বলেছেন কেচিদাহুঃ— “ কোন নির্বোধ বলতে পারে যে , তার জন্ম হয়েছে । ” স্বয়ং ভগবদ্‌গীতায় ( ৯/১১ ) কৃষ্ণ নিজেও বলেছেন , অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ “ আমি মনুষ্যাকারে আবির্ভূত হলেও , মূঢ়রা আমাকে একজন সাধারণ লোক বলেই মনে করে । " পরং ভাবমজানন্তঃ “ মানুষের মতো জন্মগ্রহণ করলেও তারা ভগবানের জন্মরহস্য সম্বন্ধে অজ্ঞ ।

       শ্রীকৃষ্ণ সর্বত্রই বিরাজমান । ভগবান হচ্ছেন সকলের হৃদয়ের অন্তর্যামী ( ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ) । কৃষ্ণ আমাদের অন্তরে রয়েছেন এবং তিনি সর্বশক্তিমান , তাই আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হওয়া তার পক্ষে কঠিন হবে কেন ? মহাভাগবত ধ্রুব মহারাজ চতুর্ভুজ বিষ্ণুমুর্তির ধ্যেয় নিমগ্ন থাকার সময় অকস্মাৎ তার ধ্যান ভঙ্গ হয় , তৎক্ষণাৎ তার সেই ধ্যায় চতুর্ভুজ বিষ্ণুকে তিনি সম্মুখে দেখেন । এভাবে আবির্ভূত হওয়া কৃষ্ণের পক্ষে কঠিন কাজ কি ? নিঃসন্দেহে নয় । সেই রকম সেই চতুর্ভূজ মুর্তিতে দেবকীর সম্মুখে আবির্ভূত হতে তাঁর পক্ষে কঠিন হয়নি । কৃষ্ণ বলেছেন , জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্ “ আমার দিব্য জন্ম কর্ম অবশ্যই হৃদয়ঙ্গম করতে হবে । ” কুন্তীদেবী এই জ্ঞান উপলব্ধি করেছেন । তিনি জানতেন যে , আপাতদৃষ্টিতে কিছু মুর্খের কাছে কৃষ্ণ জন্ম গ্রহণ করলেও , বস্তুত তিনি হচ্ছেন অজ।

       কিন্তু , কৃষ্ণ তা হলে এই জন্মলীলা করেন কেন ? কুন্তীদেবী বলেছেন , পুণ্যশ্লোকস্য কীর্তয়ে— “ যাঁরা অত্যন্ত পুণ্যবান এবং যাঁরা পরমার্থ তত্ত্বজ্ঞানে উন্নত তাদের গুণ কীর্তনের জন্য । " কৃষ্ণ তার ভক্ত দেবকীর যশ কীর্তনের জন্য দেবকীনন্দন রূপে অবতরণ করেন । কৃষ্ণ যশোদার গুণ মহিমা কীর্তনের জন্য যশোদানন্দন , সেই রকম মহান ভক্ত যদুরাজের জয়গান করার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ যদুবংশে আবির্ভূত হন । এভাবে কৃষ্ণ যাদব নামে বিখ্যাত কোন বিশেষ পরিবারে , অথবা কোন বিশেষ দেশে জন্ম গ্রহণ করতে কৃষ্ণ বাধ্য নন। কিন্তু কোন বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবারের ভক্তির বশে তাদের মাহাত্ম্য কীর্তনের জন্য তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাই তাঁর জন্মকে দিব্যম্ বা অপ্রাকৃত বলা হয় ।

       ভগবান জন্মগ্রহণে বাধ্য নন , কিন্তু আমরা জন্মগ্রহণে বাধ্য । এখানেই কৃষ্ণের জন্ম ও আমাদের জন্মে প্রভেদ । আমাদের কর্ম অনুসারে যোগ্যতা অর্জন করলে মনুষ্যসমাজে বা দেবতাদের সমাজে সদ্ বংশে জন্ম হবে , কিন্তু নীচ পাশবিক কর্মে ব্রতী হলে , আমাদের পশুকুলে জন্মগ্রহণ করতে হবে । সেটিই হচ্ছে কর্মের প্রভাব । কর্মণা দৈবনেত্রেণ জন্তুর্দেহোপত্তয়ে ( ভাঃ ৩/৩১/১ ) । কর্ম অনুসারে আমরা এক বিশেষ প্রকার দেহ লাভ করি ।

       মানব - জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে অদ্বয়তত্ত্ব , পরমব্রহ্মকে উপলব্ধি করা ( অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা ) । কিন্তু যদি পরমব্রহ্মকে উপলব্ধির প্রয়াসে উদ্যোগী না হয়ে এই সুবর্ণ সুযোগের অপব্যবহার করি এবং শুধু পশুর মতো জীবনযাপন করি , তা হলে আবার আমরা পশুযোনিতে ফিরে যাব । এই জন্য কৃষ্ণভাবনাময় আন্দোলন পশুজীবনের অধঃপতন থেকে জনগণের উদ্ধারে প্রয়াসী ।

       ভগবান কৃষ্ণের আবির্ভাবকে মলয় পর্বতের চন্দন গাছের জন্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ( মলয়স্যেব চন্দনম ) মলয় দুটি— মলয় পর্বতমালা ও মালেশীয়া নামে খ্যাত পৃথিবীর একটি অঞ্চল । মলয় পর্বতমালায় বা মালেশীয়া দেশেই চন্দন গাছ হবে এমন কোন নিয়ম নেই , যে কোন জায়গায়ই চন্দন গাছ হতে পারে , কিন্তু এই চন্দন গাছ বহুল পরিমাণে বিশ্বের এই অঞ্চলে হওয়ায় এগুলিকে মলয় চন্দন বলে । পাশ্চাত্য দেশে ঔ ডে কোলন ' নামে সুগন্ধি জল আছে । সুগন্ধি দ্রব্য যে কোন জায়গায়ই তৈরি করা যায় , কিন্তু তা সর্বপ্রথম কোলন শহরে প্রস্তুত হওয়ায় এই সুগন্ধিটির নাম ' ঔ. ডে. কোলন ' । সেই রকম চন্দন গাছ যে কোন জায়গায় হতে পারে , কিন্তু মলয় পর্বতমালা ও মালেশীয়া দেশে সর্বপ্রথম প্রসিদ্ধির জন্য এই চন্দন মলয় নামে বিখ্যাত । কুন্তীদেবী পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই বন্দনা করেছিলেন । এটি ইঙ্গিত করে যে , চন্দন গাছ হাজার বছর পূর্বে মালেশীয়া দেশে জন্মায় । মালেশীয়া কোন নতুন নাম নয় । বৈদিক সংস্কৃতির অনুগামীদের কাছে হাজার হাজার বছর আগে মালেশীয়া দেশ পরিচিত ছিল । আজকাল , অবশ্য রবারের প্রচুর চাহিদা থাকায় মালেশীয়া দেশ রবার গাছের চাষ করছে । কিন্তু পূর্বে মালেশীয়া বহুল পরিমাণে চন্দন গাছের চাষ করত কারণ তখন চন্দন কাঠের প্রচুর চাহিদা ছিল , বিশেষ করে ভারতবর্ষে ।

       ভারত যেহেতু গ্রীষ্ম প্রধান দেশ এবং চন্দন অত্যন্ত শীতল , তাই ভারতীয়রা প্রসাধন দ্রব্যরূপে চন্দন ব্যবহার করে । আজও গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ দিনগুলিতে , চন্দন সংগ্রহে সমর্থ লোকেরা সর্বাঙ্গে চন্দন লেপন করে সারাদিন স্নিগ্ধ ও শীতল অনুভব করে । ভারতবর্ষে প্রথা ছিল যে , স্নানের পর তিলক রেখা অঙ্গন দ্বারা দেহকে পবিত্র করে শ্রীবিগ্রহকে প্রণাম করা , তারপর শ্রীবিগ্রহের কক্ষ থেকে কিছু চন্দন প্রসাদ নিয়ে প্রসাধন হিসেবে দেহে ঐ চন্দন লেপন করা । এই কাজকে প্রসাধনম্ বলে । কিন্তু বর্তমান কাল কলিযুগে বলা হয় , স্নানমেব প্রসাধনম্ ( ভাঃ ১২/২/৫ ) – “ উত্তমরূপে স্নান করতে পারলে , সেটিই প্রসাধন । " ভারতে দরিদ্রতম ব্যক্তিও প্রতিদিন সকালে স্নান করবে , কিন্তু আমি আমেরিকায় এসে দেখি দিনে একবার স্নান করাও দুষ্কর এবং একবার স্নানও প্রায় কেউই করে না । ভারতে লোকদের দিনে তিনবার স্নান দেখতে আমরা অভ্যস্ত , কিন্তু নিউ ইয়র্কে স্নানের জন্য লোককে বন্ধুর বাড়ি যেতে দেখেছি , কেননা তার বাড়িতে হয়ত স্নানের কোন ব্যবস্থা নেই । এগুলি হচ্ছে কলিযুগের লক্ষণ । স্নানমেব প্রসাধনম্ । কলিযুগে এমন কি একবার স্নান করাও অতীব দুষ্কর হবে ।

       কলিযুগের আর একটি লক্ষণ হচ্ছে দাক্ষ্যং কুটুম্বভরণম্ ( ভাঃ ১২/২/৭ ) শুধু পরিবার প্রতিপালনে দক্ষতার জন্য পুণ্যবান বলে খ্যাতি লাভ করবে । দাক্ষ্যম্ ( শব্দের অর্থ ' পুণ্যকর্মের জন্য খ্যাতি , এবং এই শব্দটি এসেছে দক্ষ শব্দ থেকে , যার অর্থ হচ্ছে ' নিপুণ ' । কলিযুগে যে ব্যক্তি স্ত্রী ও দুই একটি সন্তান সহ তার পরিবার প্রতিপালন করতে পারবে , সে দক্ষ বলে খ্যাতি লাভ করবে । ভারতে , অবশ্য , রীতি অনুযায়ী এক ব্যক্তি তার স্ত্রী , পিতা - মাতা , তার সন্তান , শ্বশুর - শ্বাশুড়ী প্রভৃতি নিয়ে এক যৌথ পরিবার । কিন্তু কলিযুগে স্ত্রী , গুটিকয়েক সন্তানাদি সহ একটি সহজ - সরল পরিবার প্রতিপালন করা খুবই দুঃসাধ্য । নিউইয়র্ক শহরে থাকাকালীন , প্রবচনের সময় শ্রোতাদের মধ্যে এক বৃদ্ধা ছিলেন । তার এক পরিণত বয়স্ক ছেলে ছিল । “ আপনার ছেলে বিবাহ করে না কেন ? ” জিজ্ঞাসা করায় বৃদ্ধা উত্তর দেন , “ হ্যাঁ , পরিবার প্রতিপালনে সক্ষম হলে ছেলে বিয়ে করতে পারে । ” আমি জানতাম না যে , পরিবার প্রতিপালন করা এই দেশে খুবই কঠিন । কিন্তু ভাগবতে এই ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে পরিবার প্রতিপালনে সক্ষম ব্যক্তি মহান বলে গণ্য হবে , এবং যে মেয়ের স্বামী আছে সে অত্যন্ত ভাগ্যবতী বলে বিবেচিত হবে ।

       সমালোচনা করা আমাদের কাজ নয় , কিন্তু কলিযুগের লক্ষণ অত্যন্ত কঠোর , এবং এই কঠোরতা আরও বৃদ্ধি পাবে । কলিযুগের স্থিতিকাল ৪,৩২,০০০ বছর এবং মাত্র ৫,০০০ বছর অতিবাহিত হলেও , ইতিমধ্যেই আমরা কত দুর্বিপাক দেখছি । এই কলিযুগে আমাদের জীবনকাল অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বিপর্যয়কর কাল আসবে । তাই সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে কৃষ্ণানুশীলন পূর্ণ করে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়া । এভাবে আমরা উদ্ধার পাব । নয়তো , এই কলিযুগে অন্য জীবনে আবার আমাদের ফিরে আসতে হলে , ভাবীকাল আমাদের কাছে দুর্বিসহ হবে , এবং আমাদের আরও অনেক বেশি ক্লেশতাপ ভোগ করতে হবে ।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ১৬ ) স্বরূপ চৈতন্যে প্রত্যাবর্তন
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।