জীবসত্তা তার নিজ দেহটির কর্তা
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সকল দেহের কর্তা, অধিশ্বর
জীবাত্মা তার দেহটির গৌণ মালিক, পরমেশ্বর ভগবানই সকল দেহের মুখ্য মালিক। একজন রাজা হচ্ছেন তার রাজ্যের মূল মালিক, অধিকর্তা, আর প্রজারা হচ্ছে গৌণ অধিকর্তা। আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, কোন মালিকের একটি বাড়ী যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো ভাড়াটিয়ার কাছে ভাড়া দেওয়া থাকে, তাহলে ঐ মালিককে বলা হয় মুখ্য অধিকর্তা, আর ঐ ভাড়াটিয়াকে বলা যেতে পারে গৌণ অধিকর্তা।
ঠিক তেমনি শ্রীকৃষ্ণই সমস্ত শরীরের মালিক, আর আমরা হচ্ছি এই শরীর-রূপ নানা-আকারের গৃহগুলির ভাড়াটিয়া। ভাড়াটিয়ারা যেমন তাদের মূল্য দানের ক্ষমতা অনুসারে নানা রকম মেয়াদে থাকার অধিকার পায়, তেমনি আমরাও (জীবাত্মা) নানা কর্ম-রূপ মূল্যদানের মাধ্যমে নানা মেয়াদকালের জন্য এই সব দেহ-রূপ ঘরগুলিতে বাস করতে পারি। সুতরাং প্রত্যেক দেহে আত্মা হচ্ছে গৌণ মালিক। আর জীবাত্মা যদিও তার শরীরটির জ্ঞাতা ও মালিক, পরমেশ্বর ভগবান ঐ শরীর ও শরীরটির মালিক- উভয়েরই জ্ঞাতা এবং উভয়েরই মুখ্য মালিক।
জীবাত্মাকে বিস্মৃতির মধ্যে ফেলা যায়,
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে কখনই বিস্মৃতি অধিকার করতে পারে না।
ভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে তিনি ভগবদগীতার এই জ্ঞান কোটি কোটি বছর পূর্বে সূর্যদেব বিবস্বানকে দান করেছিলেন। অর্জুন তখন জিজ্ঞাসা করেন, “সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম হয়েছিল আপনার অনেক পূর্বে। আপনি সৃষ্টির প্রারম্ভে তাঁকে এই জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন, তা আমি কেমন করে বুঝব?” (ভ. গী. ৪/৪)। শ্রীকৃষ্ণ এই প্রশ্নটির উত্তর দিলেন, “হে পরন্তপ অর্জুন, আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।” (ভ. গী.- ৪/৫)।
বেদে বলা হয়েছে যে পরমেশ্বর ভগবান এক ও অদ্বিতীয় হলেও নিজেকে বহু রূপে প্রকাশ করেন। তিনি ঠিক বৈদুর্যমণির মতো, যা রঙ পরিবর্তন করে বহু বর্ণে প্রতিভাত হলেও সর্বদাই একই থাকে। অর্জুনের মতো ভক্তগণ ভগবানের সর্বক্ষণের সঙ্গী, আর যখনই ভগবান অবতীর্ণ হন, তখন বিভিন্ন ভাবে তাঁর সেবা করার জন্য তাঁর নিত্য পার্ষদ ভক্তগণও অবতীর্ণ হন। অর্জুন সেইরকম নিত্য ভগবৎ-পার্ষদ গণের একজন, এবং যখন কোটি কোটি বছর পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সূর্যদেব বিবস্বানকে ভগবদগীতা বলেছিলেন, তখন ভিন্ন কোনো উপযোগী রূপে অর্জুনও সেখানে ছিলেন। কিন্তু ভগবানের সংগে পার্থক্য এই যে ভগবান সেই ঘটনা স্মরণ করেছিলেন, কিন্তু অর্জুন বিস্মৃত হয়েছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন। জীবাত্মা এবং পরমাত্মার (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) মধ্যে এই হচ্ছে প্রভেদ। ভগবানের নিত্য পরিকর এমন যেকোনো ব্যক্তি নিশ্চিতভাবেই একজন মুক্ত পুরুষ, কিন্তু তিনি ভগবানের সমকক্ষ হতে পারেন না। ব্রহ্মসংহিতায় ভগবানকে অচ্যুত বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে এই যে তিনি কখনো নিজেকে বিস্মৃত হন না। সেইজন্য জীবসত্তা কখনোই ভগবানের সম পর্যায়ভুক্ত নয়, এমনকি সেই জীবসত্তা যদি অর্জুনের মতো মুক্তাত্মাও হন, তবুও নয়।
জীবসত্তার এই বিস্মৃতির প্রবণতা যুক্তিসংগত; কেননা, জীবসত্তা হচ্ছে অণু-আয়তন বিশিষ্ট এবং সে মায়া শক্তির দ্বারা পরাভূত হতে পারে, যদিও গুণগতভাবে সে ভগবানেরি মতো। এইভাবে মায়াগ্রস্ত হয়ে পড়লে জীবসত্তা পরমেশ্বর ভগবানের সান্নিধ্য থেকে ভ্রষ্ট হয় এবং সে জড়া প্রকৃ্তির কবলে পতিত হয়ে নশ্বর জড় আবরণময় দেহ-ধারণে বাধ্য হয়, তাঁর আলোকজ্জ্বল চিৎ-প্রভা আবরিত হয়ে পড়ে; ঠিক যেমন বৃহৎ অগ্নিকুণ্ডের থেকে ছিটকে আসা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-গুলি অগ্নির মতো সমগুণবিশিষ্ট হলেও অচিরেই স্তিমিত, প্রভাহীন হয়ে যায়। অর্জুনের প্রতি প্রদত্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা অনুসারে এমনকি মুক্তিলাভের পরও জীবের ব্যক্তিগত সত্তা বিলুপ্ত হয়ে যায় না, সে ‘পরমচৈতন্য’র সাথে ‘লীন’ হয়ে যায় না, কেননা আত্মা মানেই এক জন অপরিবর্তনীয় (অবিকার্যঃ ২/২৫) নিত্য, শাশ্বত, সনাতন ব্যক্তি।